সেক্টর ০৫, উত্তরা, ঢাকা

সন্ধ্যা ৬:২৫


সূর্য ডুবেছে অনেক আগেই। শীতটা আস্তে আস্তে বাড়লেও বিল্ডিংটার দোতালায় কফিশপটার ভেতরে বেশ আরামদায়ক উষ্ণতা আছে। জানালার পাশের সোফায় বসে আছি। আমার মুখোমুখি বসে স্বচ্ছ কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের ব্যস্ত কোলাহলের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।

একটু পর ফিরে তাকাল সে। "ওদের হ্যাজেলনাট কফিটা অনেকদিন পর আবার খেলাম, টেস্ট আগের মতোই দারুণ!"

"আচ্ছা" বলে নিজের জন্যে অর্ডার করা লাত্তের কাপে চুমুক দিলাম।

সে এবার তাঁর স্বভাবসুলভ চোখ বড় বড় করে তাঁর কাপটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললো, "খেয়ে দেখো"।

কিছুমাত্র ইতস্তত না করে কাপটা নিয়ে চুমুক দিতেই বেশ ভালো লাগলো। কফিটা আসলেই ভালো। আরেকবার চুমুক দিতে যেতেই সে কৃত্রিম চোখ রাঙালো আমাকে, আমি করুণ মুখে তাকাতেই ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, "লাত্তে টা ভালো লাগছে না বুঝি? হ্যাজেলনাট আরেকটা দিতে বলি?"

"নাহ, আর এক চুমুক খেলেই হবে" বলে একটু করে খেয়ে ওকে কাপটা ফেরত দিলাম।

জিজ্ঞেস করলাম, "খালামনির বাসায় কবে যাচ্ছ বললে?"

"আজ আর যাবো না। এমনিতে আজ বৃহস্পতিবার, অনেক জ্যাম হবে প্রগতি স্মরণির রোডটায়, তিন্নি যদিও বারবার করে যেতে বলেছে।"

"বলছে যেহেতু চলো তাহলে, বনশ্রী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।"

"নাহ, আজ না। বাসায় অনেক কাজ আছে। কাপড় ধুতে হবে, জমে গেছে অনেক। তার উপর খালামণি 'এটা খা ওটা খা' বলে পিছনে লেগে থাকবে। এদিকে আমার ডায়েট এখনো শেষ হয়নি।"

অর্থপূর্ন দৃষ্টিতে চাইলাম ওঁর দিকে। সেটা খেয়াল করে চোখ আর ভুরু নাচিয়ে বললো, "এই কফিতে কিচ্ছু হবে না, হুহ।"

জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আলো ঝলমলে শহরটায় ব্যস্ত মানুষ যেনো এদিকে থেকে ওদিকে কিসের আকাঙ্খায় প্রতি মুহুর্তে ছোটাছুটি করেই যাচ্ছে। আরেকটা দিন চলে গেলো- ভাবলাম আমি। ওঁকে কাছ থেকে দেখার আরেকটা দিন কমে গেলো...

"কি ভাবছো, হুম?" আমায় জিজ্ঞেস করলো সে।

"কিছু না"।

কি একটা যেনো বলতে নিতেই ওঁর ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, "তিন্নি ফোন দিয়েছে আবার। মেয়েটা আমাকে জ্বালিয়ে মারল" বলে ফোনটা ধরল। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে হতাশ ভঙ্গীতে বলল, "নাহ আজ যেতেই হবে বনশ্রী"।

"সমস্যা নেই, চলো। একটা উবার ডেকে চলে যাবো"

"যেতে দেরি হবেত্তো!"

"আমারই ভালো" বললাম আমি।

একটা দীর্ঘ মুহুর্ত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কফিটা শেষ করলাম দুজনেই।

"চলো, উঠি এবার" বলে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম।

ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়ে এলাম আমরা। সিঁড়ির সামনের জায়গাটা কিছুটা সরু এই বিল্ডিংয়ের, তাই ওঁকে এক কদম সামনে রেখে হাঁটছিলাম।

প্রথম ধাপে পা রাখতে আচমকাই ওঁর হাতটা ধরার প্রচণ্ড ইচ্ছে আমার গলায় যেনো চেপে বসতে চাইলো। কোথা থেকে এই ইচ্ছেটা আসলো, আমি জানি না। কি করবো? আগ বাড়িয়ে হাত ধরবো? বুঝতে পারছি না যেন। এদিকে হঠাৎ করে আসা এই ইচ্ছের প্রচণ্ডতা আমার অনুভূতিকে যেন অসার করে দিচ্ছে...

ঠিক তখনি- যেনো আমার মনের কথা বুঝতে পেরে আমার দিকে না ফিরেই ডান হাত পেছনে বাড়িয়ে দিলো মেয়েটা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওঁর হাতটা ধরলাম। লম্বা সিঁড়িটার দৈর্ঘ যেনো মুহুর্তেই এতটুকু হয়ে গেলো, দেখতে দেখতে সিঁড়িটা পার হয়ে আসলাম। রাস্তায় নেমে তারপর হাত ছাড়িয়ে নিলো সে।

এই কয়েক মুহুর্তের পুরোটা সময় কেউ কারো দিকে তাকাই নি, মুখে একটা শব্দ উচ্চারণ করি নি।

তখনো দুজনের কেউই জানতাম না, এর চাইতেও অন্যরকম চমৎকার কিছু আমাদের জীবনে ঘটে যাবে...