অনুতাপ এবং উপলদ্ধি
আমার নাম জন। বেশ কিছুদিন দ্বিধার ভেতরে থাকার পর অবশেষে এই লিখাটা লিখতে পারছি। নিজের ভেতরে জমে যাওয়া এই কথাগুলো আমাকে প্রকাশ করতেই হবে।
নিজের সম্পর্কে একটু বলিঃ আমার বয়স এখন ৪৬, পেশায় একজন ব্যাংকার, কিন্তু জীবনের প্রায় পুরোটা সময় আমি যা চেয়েছি, তার উল্টো কাজটাই করেছি। গত ছাব্বিশটা বছর ধরে সপ্তাহে ছয় দিন নয়টা-পাঁচটা চাকরি করতে করতে জীবনের স্বপ্ন, আকাঙ্খাগুলো সব হারিয়ে ফেলেছি। জীবনের পথে যে রাস্তাটা নিরাপদ, প্রতিটা বার আমি সেটাই বেছে নিয়েছি- আর আমার এই মানসিকতা, আমার জীবনটাকেই বদলে দিয়েছে।
আজ আমি আবিষ্কার করেছি, আমার স্ত্রী, গত দশবছর ধরে পরকীয়া করে যাচ্ছে। আমার ছেলে, আমাকে গোনাতেই ধরে না। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাইনি, কোনো কারন ছাড়াই। একটা উপন্যাস লিখা শুরু করেছিলাম, শেষ করা হয়নি। অথচ পৃথিবী ঘুরতে চেয়েছিলাম, অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম- যে কাজগুলো করবো বলে ছোটবেলাতেই ঠিক করেছিলাম। আজ যদি সেই আগের আমির সাথে এখনকার আমার দেখা হতো, তবে এখনকার আমি-র মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দিতাম, জিজ্ঞেস করতাম ওকে, কি করে এভাবে আমার স্বপ্নগুলো, আকাঙ্খাগুলো ভেস্তে গেলো।
আমার বয়স যখন বিশ, সে সময়কার কথাই বলি। তখন মনে হচ্ছিলো, আমি সত্যি চারপাশের দুনিয়াটা বদলে দেবো। মানুষ হিসেবে আমি বুদ্ধিমান, সৃজনশীল এবং চটপটে টাইপ ছিলাম, ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার মানসিকতা ছিলো, মানুষজন আমাকে এই জন্যে পছন্দ করতো। দুটো স্বপ্ন ছিলো আমারঃ কাল্পনিক বা ডিস্টোপিয়ান টাইপ একটা উপন্যাস লিখবো, আর পৃথিবী ঘুরে ঘুরে গরীব এবং অসহায় লোকদের সাহায্য করবো। এখনকার স্ত্রীর সাথে আমার ডেটিং চলছে তখন, তা-ও চার বছর হয়ে গিয়েছে। যৌবনের ভালোবাসা যা হয় আরকি- আমার চটপটে স্বভাব, আমার প্রানশক্তি, মানুষের সাথে সহজ ব্যবহার- আমার এই ব্যাপারগুলো সে খুব পছন্দ করতো। আমি জানতাম, যে বইটা লিখতে চলেছি, সেটা আলোড়ন ফেলবেই। আমার পাঠককে 'খারাপ' এবং 'নাটকীয়' ব্যাপারগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখাবো- দেখাবো যে একেকজন হয়তো একেকভাবে চিন্তা করে, কিন্তু কেউই নিজের চিন্তার ভুলটা ধরতে পারে না। সেই সময়েই উপন্যাসের প্রায় সত্তর পাতার মতো লিখে ফেলেছিলাম। ততদিনে ফিলিপাইন আর নিউজিল্যান্ড ঘোরা হয়ে গিয়েছিলো। পরিকল্পনা ছিলো পুরো এশিয়া ঘোরার, তারপর ইয়োরোপ, এবং তারপর আমেরিকা (আমি অস্ট্রেলিয়াতে থাকি)। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই ফিলিপাইন আর নিউজিল্যান্ড ভ্রমন করার পর, আর কোথাও যাওয়া হয়নি।
কি করে সবকিছু ভেস্তে গেলো, এবার সে প্রসঙ্গে আসি। তখন, মানে সেই বিশ বছর বয়সে, পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি থিতু হয়ে চেয়েছিলাম। মানে হলো গ্রাজুয়েশানের পর একটা স্থায়ী চাকরি পাওয়া, তারপর নয়টা-পাঁচটা চাকরি করে যাওয়া- আর এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস! তখন আসলে ভাবছিলামটা কি আমি?
অফিস থেকে বাসায় ফিরে রাতের ডিনার তৈরি করি, আগামীকালের কাজগুলো গুছিয়ে রাখি, দশটার দিকে ঘুমিয়ে ভোর ছটায় উঠে যাই- চাকরিটাই যেনো আমার জীবন। খোদা, শেষ কবে স্ত্রীর সাথে একান্ত সময় কাটিয়েছি, আমি এখন মনে করতে পারছিনা।
আমার স্ত্রী গতকাল তার পরকীয়ার ব্যাপারটা স্বীকার করেছে। গত দশ বছর ধরে এমনটা নাকি হয়ে আসছে। দশ বছর- অনেকটা সময় মনে হলেও আমার কাছে তেমনটা মনে হচ্ছে না। আমার এমনকি কষ্টও লাগছে না। আমি নাকি আগের সে মানুষটা নেই- আমার স্ত্রীর ভাষ্যে এটাই পরকীয়ার কারন। গত দশটা বছর আসলেই আমি করেছিটা কি? কারও স্বামী হিসেবে হোক বা নিজের জন্যে, কাজের বাইরে বলার মতো কিছুই তো করি নি।
ওর ব্যাপারটা জানার পর আমি ডিভোর্সের ব্যাপারে তখন কিছুই বলিনি, ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করি নি, এমনকি কাঁদিও নি। কিছুই অনুভব করি নি আমি, কিচ্ছু না। কিন্তু এই লিখাটা লিখতে লিখতে আমার চোখে পানি চলে এসেছে, কারন এখন বুঝতে পারছি- ভেতরে ভেতরে আমি মরে যাচ্ছি। আমোদপ্রিয়, ঝুঁকি নিতে, পৃথিবীটাকে বদলে দিতে প্রস্তুত, সেই প্রানোচ্ছল আমার আমি'র এ কি হাল হয়েছে!
মনে আছে স্কুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়েটা আমাকে ডেটের প্রস্তাব দিয়েছিলো, কিন্তু আমার এখনকার স্ত্রীর জন্যে আমি তা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম... খোদা, স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের কাছে কি জনপ্রিয়ই না ছিলাম আমি। কিন্তু আমি আমার স্ত্রীর প্রতি অনুগত ছিলাম। এদিক ওদিক কোথাও তাকাইনি। মন দিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করে গিয়েছি।
একটু আগে বলেছিলাম না উপন্যাস লিখবো, ব্যাকপ্যাকিং করে সারা দুনিয়া ঘুরবো? যতটুকুই হয়েছে, তার সবই কলেজের প্রথম কয়েক বছর- পার্টটাইম চাকরি করতাম, সেই উপার্জনে হাত খুলে খরচ করতাম। আর এখন, আমি প্রতিটা পয়সা বাঁচিয়ে চলি। শেষবার কবে বলার মতো কোনো বিনোদনের পেছনে কিছু খরচ করেছি, মনে করতে পারছি না। এখন, এই সময়ে এসে নিজের জন্যে আসলে কি চাই আমি?
বাবা মারা গিয়েছেন দশ বছর আগে। আমার মনে আছে, সেসময় মা ফোন দিয়ে বারবারই বাবার কথা বলতো, বলতো দিনকে দিন মানুষটা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার নিজের কাজের ব্যস্ততা বেড়েই চলছিলো- প্রমোশান নিতে হবে বলে কথা। তাদেরকে দেখতে যাওয়া হতো না সেভাবে, ভাবতাম, এইবারটা বাবা সামলে নেবেন।
বাবা মারা গেলেন। আমার প্রমোশানও হলো। পনেরোটা বছর, বাবার সাথে দেখা করি নি। যখন মারা যাবার সংবাদ পেলাম, নিজেকে বোঝালাম এটা কোনো ব্যাপার না। অস্তিবাদে আমার বিশ্বাস নেই- তাই ভেবেছিলাম, যে মরে গিয়েছে, কি হবে তাঁর কথা ভেবে...
আমি ভাবছিলামটা কি আসলে!
সবকিছুতে যুক্তি দেখানো, কোনো একটা অজুহাতে কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া, অযথা দেরি করা- এই ব্যাপারগুলোর ফলাফল একটাই- কিছুই না। তখন বুঝতাম, আর্থিক নিরাপত্তাটাই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর এখন বুঝি, এটা মোটেও সত্যি নয়।
আফসোস করি, যখন প্রানশক্তিতে ভরপুর ছিলাম, বলার মতো কিছুই করিনি আমি। আমার উদ্যম, আমার যৌবন সবকিছু নয়টা-পাঁচটা চাকরি করতে করতেই চলে গিয়েছে। আফসোস করি, টাকা বানানোর মেশিন হয়েছি, ভালো স্বামী হতে পারি নি। আফসোস করি, অসম্পূর্ণ উপন্যাসটা লিখে শেষ করতে পারি নি। আফসোস করি, পৃথিবীটা আমার আর ঘুরে দেখা হয় নি। আফসোস করি, নিজের ছেলেকে সময়টুকু দিতে পারি নি, একটা জড়, অনুভূতিহীন টাকার ওয়ালেট হয়ে থেকেছি।
যদি এই লিখাটা আপনি পড়ে থাকেন, এবং আপনার হাতে এখনো সময় থাকেঃ দয়া আমার মতো গড়িমসি করবেন না, নিজের স্বপ্নগুলোকে এভাবে ত্যাগ করবেন না, 'পরে করবো' বলে ফেলে রাখবেন না- অনুরোধ করছি আপনাকে। উদ্যমী হোন, নিজের প্যাশনকে জাগিয়ে তুলুন। দরকার ছাড়া ইন্টারনেটে বসে থাকা বাদ দিয়ে দিন। যতদিন যৌবনে আছেন- দয়া করে কিছু একটা করুন। আমার মতো কম বয়সে থিতু হবার চেষ্টা করবেন না। কাছের বন্ধুদের, নিজের পরিবারকে, নিজেকে কখনো ভুলে যাবেন না। জীবনকে, জীবনের উচ্চাশাগুলোকে দয়া করে আমার মতো নষ্ট করে দেবেন না।
পুনশ্চঃ আমি বুঝতে পেরেছি, শুধু অর্থ উপার্জনের উপায়চিন্তা করতে করতে যৌবনেই নিজের প্যাশনগুলোকে আমি জলাঞ্জলি দিয়েছি। আর এখন, ভেতরে ভেতরে আমি বৃদ্ধ, ক্লান্ত, মৃত।
(লিখাটি রেডিটের TIFU চ্যানেলের 'My regrets as a 46 year old, and advice to others at a crossroad' শিরোনামে একটি জনপ্রিয় পোস্ট থেকে রুপান্তর করা হয়েছে। মূল পোস্ট লিঙ্ক পাওয়া যাবে এখানে )