জীবন কঠিন - কতোটা?
মাঝে মাঝে কথার ছলে আমার বাবা বলে ওঠেন, "জীবনটা বড় কঠিন বাবা, অনেক কঠিন।" আমার বাবা আক্ষরিক অর্থেই জীবনের অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন। শুন্য থেকে তিনি অনেকদূর এসেছেন। আমার নিজের ঘরে বসে আমি এখন যে এই লিখাটা লিখছি, উনি কঠিন পরিশ্রম না করলে আরও অনেক কিছুর মতো এই লিখাটাও লিখা হতো না। বাবাকে নিয়ে আরেকদিন লিখা যাবে। জীবনটা বৈচিত্র একটা শিশু কখন আবিষ্কার করে? সেটা অনেকটাই নির্ভর করে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের উপর - পরিবার এবং বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের ছক বাঁধা পরিবেশ অনেক কিছুই আড়াল করে রাখে, তাই এখানে ঠিক বিদ্যালয়কে এই দিক দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। বাকি থাকে পরিবার। যে শিশুটা বোধ হবার পর থেকে আবিষ্কার করেছে অন্য অনেকের মতো তাঁর মা বাবা বলতে কেউ নেই, আর যে শিশুটাকে স্কুলে আনা নেয়ার করার জন্যে গাড়ি থাকে, সকালে ঘুম ওঠানো থেকে শুরু করে রাতে ঘুমুতে যাওয়ার পুরো ব্যাপারটা যত্নের সাথে যে পরিবশে পরিচালন হয় - দু জনের কাঠিন্যের ক্ষেত্র কি আলাদা হবে?
হ্যাঁ, সেটা ঐকিক নিয়মে বলে দেয়া যায়। তবে পূর্বপুরুষের সচ্ছলতা দিয়ে জীবনের কাঠিন্য থেকে কতটুকু মুক্তি যাওয়া যাবে? যখন কেউ এই দুটো শিশুর তুলনা করতে যাবে, তখনই ভুলটা হয়ে যায়। প্রতিটা জীবন স্বতন্ত্র, প্রতিটা মানুষের গল্প আলাদা। অভাবে অনটনের সাথে যুদ্ধ করে যাওয়া শেখ সাদী লোকটার পা নেই বলে জুতো না থাকার দুঃখ ভুলেছিলেন। তাতে করে তাঁর জুতোর সমস্যার সমাধান হয়নি, তিনি নিজেকে অবস্থা তুলনা করে মানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সবাই শেখ সাদীর জুতোর অভাব দেখতে গিয়ে ওই পা হারানো লোকটার দুঃখটা কি ভেবেছে? হ্যাঁ, সাদী ভেবেছিলেন কিন্তু তাঁর গল্পের শ্রোতারা যদি জানতে চাইতো তাহলে হয়তো মসজিদ আল কুফায় শুয়ে থাকা ওই পা হারানোর লোকটার অন্য রকম যুদ্ধের গল্প শুনতে পেতো। সে গল্পে হয়তো জুতোর দুঃখ থাকতো না, অন্য কোনো অভাবের কথা থাকতো, অন্য কোনো সংগ্রামের কথা থাকতো। তাই বলে কি সাদীর জুতো কেনার অর্থের অভাবের সাথে সে দুঃখ তুলনীয়? জীবনটা তো সে ব্যক্তির কাছে অন্য মাত্রায় কঠিন। জগতের কাঠিন্য মানুষকে সচেতন করে। কেউ কেউ ভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে সেই কাঠিন্যের মুখোমুখি হয়ে যায়। আমাদের কারও জীবনই সরলরেখায় চলার জন্যে নয়। সরলরেখা - সে তো মৃত্যু। জীবনের পথটুকু চলতে আমাদের গতি দিতেই হয়। আর গতিময় সে পথে বাঁধা থাকাটাই স্বাভাবিক। জীবনের রূপগুলো আবিষ্কার করা যায় তখনই যখন চলার পথে বাঁধার মুখে পড়তে হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী লোকটাও পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হন। তাহলে জীবনের কাঠিন্য নিয়ে আমাদের এতো অভিযোগ কেন? জীবনের বাঁধা নিয়ে আমাদের ধারনাটা বেশ নেতিবচক বলেই আমরা এমনটা মনে করি। বাঁধাগুলোর প্রতি আমাদের ভুল আচরনই আমাদেরকে বিচলিত করে, অসহায় অনুভব করায়, হাল ছেড়ে দিতে বলে। যা অনিবার্য, তা হলো, জীবন আমাদের সামনে কঠিন হিসেবে আসবেই। এই আসাটা সমস্যা নয়। আমরা জীবনের সমস্যাগুলোকে কিভাবে ব্যাখ্যা করছি (ইংরেজী interpretation শব্দটা এখানে বেশি যৌক্তিক) তার উপরেই নির্ভর করে আমাদের আচরন (action) এবং সে অনুযায়ী আমাদের জীবন-যাপন (lifestyle)। জীবনটাকে এমনভাবে গড়ে নেয়া উচিত, যেনো কারও কাছে থেকে জীবনের কাঠিন্য নিয়ে নতুনভাবে আবিষ্কার না করতে হয়, এমনকি তা নিজের বাবার কাছে থেকে হলেও। (চলবে)