ছেঁড়া পাতার গদ্য - ১৩
ড্রেসডেন, স্যাক্সন, জার্মানি
রাত ১১ঃ৩৫
...বালিশে পিঠ দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেছিল সে। হাতের বইটা লাইব্রেরিয়ান মেয়েটার দেয়া- এই বইয়ের একটা চরিত্রের সাথে নাকি তাঁর অনেক মিল আছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মানে সে জিজ্ঞেস করেছিলো-
"কি করে বুঝলে?"
তাঁর জার্মান শুনে মেয়েটা হেসে ফেলতেই ব্রেস লাগানো দাঁতগুলো দেখতে পেলো সে। প্রায় পরিষ্কার ইংরেজিতে বলেছিলো-
"সমস্যা নেই, ইংরেজিতে কথা বলতে পারো আমার সাথে। আর যেদিন তুমি প্রথম লাইব্রেরিতে এসেছিলে, সেদিন হেড লাইব্রেরিয়ানের সাথে একটা ঝামেলা হয়েছিলো, মেজাজ খারাপ করে পর্টিকোর একপাশে বসে এই বইটায় মন দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। মন বসছিলো না। লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখে সিঁড়িতে পড়ে যাচ্ছিলে, তোমার দিকে চোখ পড়তে দেখলাম নিজেকে সামলে নিচ্ছ (হাসি)। তখন মনে হলো, এখানকার একটা চরিত্রের বর্ণনার সাথে তোমার চেহারা মিলে যায়।"
এবার তাঁর মনে পড়ল, সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা এটা। আনমনে থাকায় সিঁড়ির উঁচু কদমে প্রায় আছাড় খেয়ে পড়েই যাচ্ছিলো। আর মেয়েটা এইটুকুতেই ওঁকে মনে রাখলো কেন?
"পড়েই দ্যাখো, তোমার হয়তো ভালো লাগবে"- মেয়েটা আবার বলল।
সে কিছু না বলে বইটা নিয়ে ব্যাক কভারের পেছনে থাকা কার্ডটায় নিজের নাম ঠিকানা লিখে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
"হ্যাপি রিডিং"- বলে মেয়েটা কার্ডটা রেখে ডেস্কের সামনে বই নিতে আসা আরেকজনের দিকে মন দিলো।
বাইরে বের হয়ে ড্রেসডেনের আকাশ দেখছিল সে। টানা তিনদিন ধরে একঘেয়ে তুষার পড়েই যাচ্ছে। এপার্টমেন্টটা এখান থেকে আধা কিলোমিটার। হেঁটেই যাওয়া যায়।
মেয়েটা আগ বাড়িয়ে কেন বইটা দিলো, অন্য সময় হলে স্বভাবমতো চিন্তা করতো সে।
কিন্তু, আজকাল কিছুই আর ভাবতে ইচ্ছে করে না। এই দেশটাতে আসার পর থেকেই নিজের ভেতর এটা খেয়াল করেছে সে- অদ্ভুত এক অবসাদ।
রিডিং ল্যাম্পের হলুদ আলোতে বইটা পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। মন বসছে না।
দেশের কথা চিন্তা করলো। কখনো ভাবে নি, এভাবে তাঁকে দেশ ছেড়ে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে আসতে হবে...
বাবা অসুস্থতার সময়টায় ঠিকমতো পড়াশোনা করাও সম্ভব হয়নি। ভার্সিটি জীবনের প্রায় পুরোটা সময় চলে গিয়েছে বাবার চিকিৎসার জন্যে। বাবা মারা যাবার পর নিজের আর পরিবারের বাকি দুজনের কথা ভেবে দেড় বছর সময় নিয়ে, বাবার রেখে যাওয়া অল্প জমিটায় পুরো ছয় তলা বিল্ডিংটার কাজ শেষ করেছিলো। পাইলিং থেকে শুরু করে রং করার কাজ।
তখন তাঁর বয়স ছাব্বিশ বছর।
ভার্সিটিতে যেদিন সবাই কনভোকেশানে টুপি খুলে উৎসব করছিলো, একই সময়ে ট্রাকের পেছনে বসে ঢাকার বাইরে থেকে নতুন বাসার মালামাল নিয়ে আসার কাজে ব্যস্ত ছিল সে।
পরিবারের থাকার সুবিধার জন্যে দুই আর তিন তলা একসাথে করে ডুপ্লেক্স বানিয়েছিল সে। দিন আর রাত এক করে প্রতিটা দিন খাটতে হয়েছিলো। চুল দাঁড়ি দুটোতেই তাই পাক ধরেছিলো সেই বয়সেই।
"ভেতরে পিলার এতোগুলো কেনো?"- নিজের মায়ের কাছ থেকে সদ্য তৈরি করা নিজেদের ফ্ল্যাটের প্রশংসা এভাবেই পেয়েছিলো সে।
"আমার রুমের এটাচ বাথরুম কোথায়?"- বোনের জিজ্ঞাসা ছিল এটা। কেন ওইরুমটাতে বাথরুম করা সম্ভব না, ব্যাখ্যা করেছিলো সে, লাভ হয়নি।
বাবার বানানো পুরনো হয়ে যাওয়া বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠেছিলো, এরকম অনেক অনেক 'প্রশংসাপত্র' হজম করে।
দিনের পর দিন ঘরের মানুষগুলোর সাথে মনোমালিন্যতা, সেখান থেকে তিক্ততা। এদিকে চাকরিতে কাজের চাপ। ওদিকে বন্ধুরা বলে "বিয়ে করে ফেলো।"
তারপর একদিন মা এসে জানালো, "তোমার বোনের বিয়ে দিতে হবে। ছেলে ওর পছন্দের।"
আচ্ছা। তো ছেলে কি করে? কোথায় থাকে? উত্তরে জানতে পারলো, ছেলের ঢাকায় স্থায়ী নিবাস নেই।
"বেশ, তাহলে বিয়ের পর কি হবে?"
"কেন, এই বাসার পাঁচতলায় থাকবে।"
মাথা প্রচণ্ড গরম হয়ে গিয়েছিলো তাঁর, "মেয়ের জন্যে ঘরজামাই আনতে চাইতেসো? এ কেমন ছেলে?"
এক কথায় দু কথা, দু কথায় চার কথা। চলতেই থাকলো। শেষে বোন এসে জানালো-
"তোমার এই বিয়েতে মত না থাকলে, আম্মুরও মত না থাকলে কিছু আসে যায় না। সম্পত্তির যা ভাগ পাবো, আমারটুকু আমাকে বুঝিয়ে দাও। আর হ্যাঁ, আমি দুইটা বাসা থেকেই ভাগ নিবো।"
বোনের কথা শুনে মায়ের দিকে তাকাল সে। মা চুপ করে ছিল।
"বেশ, উকিল ডাকো। ব্যাপারটার একটা ফয়সালা হয়ে যাক।" বলেছিল সে।
উকিল ডাকার আগে মা কে ডেকে বলল, "মা, পুরনো বাসাটা বাবার নিজ হাতে বানানো। জীবনের অনেকগুলো স্মৃতি সেখানে। এটা ভাগ করো না। এখানে মিতুর অংশ যতটুকু আসবে, টাকার মূল্যে আমি শোধ করে দেবো। এই নতুন বাড়ি থেকে ও ভাগ নিক। গ্রামে তুমি যা যা পাবে, আমি সেগুলোও ছেড়ে দেবো।"
মা রাজি হলেন না।
উকিল ডাকা হলো। শুক্রবারের বিকেল ছিল সেটা।
সেখানেও সে যখন বণ্টনের এই প্রস্তাবটা করলো, তাঁর মা আর বোন বলে উঠলো, "মানি না"।
কিন্তু অন্য আরেক প্রস্তাবে নতুন বাসার অংশ ছাড়া পুরনো বাসা পুরোটা দিয়ে তাঁর বোনকে দেয়ার প্রস্তাব উঠলো। তাঁর বোন এটায় রাজী।
মা এই জায়গায় চুপ করে থাকলেন। পরে বলে উঠলেন, নতুন বাসার অংশ লাগবে। মেয়েকে বিয়ে দেবেন, বাসায় শ্বশুরবড়ির লোকজন আসবে। কত কত মেহমান আসবে। তাদের নিয়ে পুরনো বাসায় বসাবেন নাকি?
তারপর অনেক কথা। অনেক অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ। তিক্ততা, এবং আরও তিক্ততা।
শেষটায় দুটো বাসায়ই ভাগ হলো। তাঁর বোন ভাগ বসালো। এখান থেকে এক খাবলা। ওখান থেকে এক খাবলা...
নিজে কিছু করতে পারুক আর না পারুক, পুরনো বাসায় ভাইকে বোন নতুন করে কিছু করতে দেবে না- উপস্থিত সবাই সেদিন বুঝতে পেরেছিল এই মনোভাব।
সেদিন ক্লান্ত শরীরে বাসার বাইরে আসার সময় গ্যারেজে থাকা পোষা কুকুরটার দিকে তাকিয়েছিল সে। ওকেও কি তিন ভাগে...
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে। টেবিলে রাখা হুইস্কির বোতল থেকে তিন আঙ্গুল পরিমাণ তরল ঢেলে নিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। তিনতলা থেকে শুধু আকাশটা দেখা যায় ঠিকমতো। তুষারে সব কিছু ঢেকে আছে। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে সবকিছু ভুলে থাকতে পারলেও রাতের বেলায় ঐ চিন্তাগুলো যেন নতুন উদ্যোমে আঘাত করে। নতুন করে ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি করে।
বাইরে তাকালো সে, ল্যাম্পপোস্টের আলো তুষার ঝড়ে অষ্পস্ট দেখা যাচ্ছে। এখানে আসা পর্যন্ত 'ওঅর পাহাড়'এ একবারও যাওয়ার সুযোগ হয় নি। আগামী দু সপ্তাহ সময় করে উঠতে পারবে না, জানে সে। তারপর নাহয়...
ঠিক এই সময়ে, কলিংবেলটা বেজে উঠলো...