ছেঁড়া পাতার গদ্য - ১২
রোড নং ১৯, বনানী, ঢাকা
বিকাল ৪:৩২
বাস থেকে নেমেই ঘামতে শুরু করেছি।
শীত তখনও ভালোভাবে পড়েনি। বিকেলের এই সময়ও তাই রোদের কিছুটা তেজ আছে। তার উপর এয়ার কন্ডিশনড বাসে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ করে নেমে যাওয়াতে গরমটা যেন একটু বেশিই লাগছে।
ডানে বাঁয়ে দুবার তাকিয়ে একটুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ওর নম্বরে ডায়াল করতেই পাশ থেকে বলে উঠলো, "এইই যে! আমি এখানে!"
ফিরে তাকাতেই পরপর দুটো হার্টবিট মিস হয়ে গেলো।
উবার কখন এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করি নি। গাড়ি থেকে নেমেই মেয়েটা আমাকে দেখতে পেয়ে ডাক দিয়েছে। চুলটা বেঁধেছে কিছুটা পনিটেইল করে। কলাপাতা রংয়ের সালওয়ার কামিজ পরেছিল সেদিন।
এই প্রথম সামনাসামনি ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলো মেয়েটা।
"একদম সময়মতো চলে এসেছেন! আসুন!"- এই বলে ও এগোতে লাগলো। ঘোর তখনো কাটেনি, দম দেয়া পুতুলের মতো ওকে অনুসরণ করলাম।
একটা ভবনের ভেতরে ঢুকে তিনতলায় চলে এসেছি আমরা। সামনে কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আমাকে ইশারা করলো ও। ভেতরে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেলো। টিপিক্যাল রেস্টুরেন্টের তুলনায় একদম অন্যরকম পরিবেশ। পুরো ফ্লোরটা জুড়ে বেশ গুছিয়ে নানান রঙয়ের আর রকমের আসবাব দিয়ে সাজানো জায়গাটা। কাঠের নানা কারুকাজের নাম না জানা আসবাব আর পুতুল থাকে থাকে সাজানো। দেয়ালের কোণে ছোট্ট একটা বুকশেলফে চমৎকার কিছু বই রাখা। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা মানুষজন চা খাচ্ছে আর নিচু গলায় গল্প করছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে আমার না জানা কোন একজন শিল্পী, শান্ত এবং প্রায় নীরব এই পরিবেশের পরিপূর্নতা রক্ষা করছে গানটা।
এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা জায়গা দেখিয়ে স্বভাবসুলভ কলকল করে বলে চললো, "আমি এখানে আসলে ওই জায়গাটায় বসতাম! একটা কারণ হলো, এখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়! চা খেতে খেতে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে!" ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি, নিচু বেঞ্চের মতো জায়গাটাতে পা গুটিয়ে আরাম করে একজোড়া কাপল বসে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, "পুরো জায়গাটাই বেশ দারুন।"
"হুঁ হুঁ! আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা! চলুন চেয়ারে বসি আপাতত। ওরা উঠে গেলে ওইখানে বসা যাবে!"
চারকোনা টেবিল ঘিরে থাকা কাঠের চেয়ারে বসলাম আমরা। বসার পর কিছুক্ষণ দুজনের কেউ যেনো কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। "কিটো আর কতদিন করবে?"
"আজকে বিরতি দিয়েছি! কাল থেকে আবার শুরু করবো!"
"কন্টিনিউ করতে চাইছ যেহেতু, কোন নিউট্রিশনিস্টের সাথে কথা বলে তারপর করো। কিটো করতে গিয়ে পরে সমস্যা হতে পারে।" সে মাথা নাড়ল, ভাবেসাবে বুঝলাম, উপদেশটা একদম জলে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ উশখুশ করে জিজ্ঞেস করলাম। "ইয়ে, ওইটা এনেছ?"
সে আমার দিকে তাকিয়ে ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা কাগজের শপিং ব্যাগ বের করলো। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে প্লাস্টিকের একটা টিফিন বক্স বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। "এই নিন!"
টিফিন বক্সটা খুললাম। বক্সের নিমকিগুলো তখনো বেশ গরম ছিল। একটা তুলে নিয়ে মুখে দিলাম। "উমম, ভালো হয়েছে"। বলে আরেকটা মুখে দিয়েছি। সে বলল, "আমি জানি মজা হয়েছে, খেতে থাকুন!" বলে সে মোবাইলে একটু যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
একের পর এক নিমকি খেয়ে যাচ্ছি। প্রায় অর্ধেকের বেশি শেষ হবার পর আবিষ্কার করলাম, শুকনো নিমকি একটানা এতোগুলো খেয়ে গলায় যেন আটকে গিয়েছে। পানি খেতে হবে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে সে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। "গপাগপ করে খাচ্ছেন দেখছি, এতো ভালো হয়েছে?"
আমি "হুঁ" বলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। অদূরে কাউন্টারে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। ও জিজ্ঞেস করলো, "পিপাসা পেয়েছে?"
আমি কোঁ কোঁ করে কোনোমতে বললাম, "গলায় আটকে গিয়েছে"। ফিক করে হেসে দিলো সে। "খুব ভালো হয়েছে! একসাথে ওতগুলো খেতে গেলেন কেনো?"
আমি ততক্ষণে চোখ মুখ হাঁ করে হাঁসফাঁস করে শ্বাস নিচ্ছি, সেটা দেখে ওর হাসি যেনো আরও বেড়ে গিয়েছিলো...
ওদিকে, আমাদের অজান্তেই, বিকেলের শেষ আলোটুকু আস্তে আস্তে মলিন হয়ে যচ্ছিলো...