বই আলোচন ০১ - বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে
ফাহাম আব্দুস সালাম রচিত 'বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে' বইটি মূলত ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের ভেতর সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা লেখকের কিছু লিখার সংকলন। সমসাময়িক কিছু প্রসঙ্গ ছাড়াও এখানে বেশ কয়েকটি উল্লেখ করার মতো প্রবন্ধ আছে, যা সামনের দিনগুলোতেও চিন্তার এবং আলোচনার খোরাক তৈরি করবে। বইয়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লিখা নিয়ে বলা যাক-
প্রথম লিখাটির নাম 'বাঙালির বিপ্লব'। বিপ্লব ব্যাপারটাকে বাঙালিজাতি নিজের মতো করে আবিষ্কার করে নিয়েছে, বিপ্লবের ব্যাপারে এখানকার মানুষজনের দৃষ্টিভঙ্গী তাদের মানসিকতারই প্রতিফলন- এই লিখাটা পড়লে তা বোঝা যায়। লিখায় উল্লেখ করার মতো অনেক কিছুই আছে, যেমন লেখকের মতে 'কালেক্টিভ ঔনারশিপ' বা সামস্টিক মালিকানা কি এটা এখনো এ দেশের মানুষ ঠিকভাবে বুঝতে পারে নি। কারন হিসেবে লেখকের ভাষায়
একটা প্রাচীন সমাজ দীর্ঘদিন উপনিবেশ থাকার কারণে এবং তারপরে খুব দ্রুত পুঁজিবাদী সমাজে উত্তরণের কারনে তার জন্যে সামষ্টিক মালিকানার কনসেপ্ট বোঝা কষ্টকর।
এই অবস্থায় বাঙালি যদি পরিবর্তন চায়, তবে সেখানে যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে তা আদতে কোনো বিপ্লব নয়। কারন বিপ্লব ব্যাপারটার ধারণাটাই উড়িয়ে দিতে একটু পরই লেখক বলেছেনঃ
...পৃথিবীতে বিপ্লব বলে আসলে কিছু নেই। কখনো কখনো বিবর্তন খুব দ্রুত ঘটলে আমরা অভিজ্ঞতা আর শব্দের অভাবে এর নামে দেই বিপ্লব।
বাংলা ভাষা যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলেও যারা কখনো অনুবাদ কর্ম করতে গিয়েছেন, বা যারা অন্য ভাষার কোনো ব্যাপার নিজের ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তাদেরকে সময়ে সময়ে হোঁচট খেতে হয়, এই হোঁচট খাওয়ার কারন দুটোঃ এক, ব্যক্তির নিজের জানার অভাব (যদি সামনে গুগল বা ডিকশনারি থাকে, পরিস্থিতি সাপেক্ষে শব্দ প্রয়োগের ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তবে অবশ্য এই অভাব পূরন করা যায়) এবং দুই, নিজ ভাষায় উপযুক্ত শব্দের বা পরিভাষার অভাব। বইয়ের দ্বিতীয় লিখা 'শেকায়েতনামা'য় এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গটি বোঝানোর জন্যে লেখক এক পর্যায়ে বাংলাদেশের সর্বকালের জনপ্রিয় বাংলা টিভি সিরিয়াল 'বহুব্রীহি' এবং ইংরেজী টিভি সিরিয়াল 'Breaking Bad' এর একটি করে এপিসোডের স্ক্রিপ্ট থেকে Unique Verb analysis করে কিছু চমৎকার পর্যবেক্ষন দেখিয়েছেন, বইয়ের আগ্রহী পাঠকদের জন্যেই সেটা তুলে রাখছি।
যে কোনো এলাকার ভাষার শব্দভান্ডারের সাথে সেখানকার মানুষের চিন্তার যোগসূত্রের সরাসরি সম্পর্ক আছে, ভাষার প্রকাশ চিন্তাশক্তিকে প্রভাবিত করে- ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম, লেখকের কথায় সেটাই যেনো নতুন করে আবিষ্কার করলামঃ
... এবং হ্যাঁ, শব্দভান্ডারের দীনতা আমাদের ক্ষতি করে। আপনি যদি প্রচুর শব্দ না জানেন, যদি শব্দের সীমানা না জানেন তাহলে প্রথমত আপনার চিন্তা প্রসারিত হবে না এবং দ্বিতীয়ত আপনার চিন্তা ভাষায় প্রকাশের ক্ষেত্রে আপস করতে বাধ্য হবেন।
আমাদের দেশের লেখক, প্রকাশক এবং প্রকাশনীর ব্যাপারে আমার আগ্রহ আছে। এইটুকু জানি, 'ফুলটাইম' বই লেখক এই দেশে দূর্লভ। কিন্তু কেউ যদি লিখেই সম্মানজনক একটা জীবিকা অর্জন করতে চান, তাহলে তাকে কি করতে হবে? উত্তরটা বেশ কিছুটা সময় আমাকে ভাবিয়েছিলো, এবং সবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলাম- এটা সম্ভব, যদি লিখাটা ইংরেজীতে হয় এবং ভালো ইংরেজী প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয় (যদিও এটাই একমাত্র পন্থা নয়)...
বইয়ের তৃতীয় লিখা 'অপ্রমিত'এ লেখক এই ভাষার ব্যাপারে যেনো আরও স্পষ্ট হয়েছেন, দেখিয়েছেন নিজ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব কতটুকু। বাংলা ভাষায় সাহিত্যিকদের আর্থিক দৈন্যতা বিচারোলোচনের পর পরই করে আমাকে চমকে দিয়ে উনি লিখেছেনঃ
লিখে রাখুন- এখন থেকে তিরিশ বছর পর বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল সাহিত্যিক বাংলাদেশে বসেই ইংরেজী উপন্যাস লিখবেন এবং আপনি সেই উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ পড়বেন।
লেখকদের জীবিকা উপায় নিয়ে যে ধারণা করেছিলাম, লেখক সেটাই লিখেছেন। তবে উনি যথেষ্ট আশাবাদী, তাই সম্ভবত ত্রিশ বছর সময় নিয়েছেন। এই দেশের জাত লেখকরা এর আগেই এই রাস্তায় হাঁটা শুরু করবেন বলে মনে করি। হয়তো সব লিখা না হলেও তাদের সাহিত্যজীবনের একটা বড় অংশ লিখা প্রকাশের ক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষাই ব্যবহার করবেন। ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলার চেয়ে ইংরেজী ঢের সহজ, সবালীল- এটা এতোদিন আমার অনুমানে আর অভিজ্ঞতায় ছিলো, লেখকের কথায় তা নিশ্চিত হয়েছি। ইংরেজী শিক্ষা আমাদের দেশে সার্বজনীন নয় কোনোভাবেই, এই ভাষায় প্রকাশ-দক্ষতার সুফল ভোগ করে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়? লেখকের ভাষায়-
এই অবস্থার পরিবর্তন হবে শুধু তখনই যখন গ্রামের ছেলেটাও চোস্ত ইংরেজিতে যোগাযোগ করবে। আশ্চর্য হবেন না, আশি বছর আগে এই বড় বঙ্গেই ঘটনাটা অহরহ ঘটতো। তখনকার গ্রামের ছেলেটা গ্রামে থেকেই ভালো ইংরেজি শিখে, মেধার জোড়ে নিজের পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো।
এমন পর্যায়ে যাওয়ার পথটুকু কেমন হবে? লেখক এ ব্যাপারে মত দেবার আগে ভাষার পান্ডিত্যের উপর অপ্রাগতা প্রথমেই স্বীকার করে নিয়ে তারপর নিজের মতটা বলেছেন-
বাংলা ভাষাভাষীদের এমন একটা পর্যায়ে যেতে হবে যেখানে ভালো বাংলা জানা আর ভালো ইংরেজি জানা সমার্থক হয়ে উঠবে। এই ফ্লুয়িড অবস্থাটায় আপনি বাংলা না ইংরেজি ব্যবহার করবেন সেটা হবে একটা ভাষিক সিদ্ধান্ত, সামাজিক গুরুতারোপের বিষয় নয়।
এর পরের লিখাটিও এই ইংরেজী শিক্ষা নিয়েই তবে এখানে কনটেক্সটটা হলো বিজ্ঞান। লেখক জোর গলায় বিজ্ঞাম শিক্ষায় ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের কথা বলেছেন, দ্বিমত পোষন করেছেন বাংলায় বিজ্ঞানের প্রচলিত শব্দগুলোর অনুবাদের সমর্থন দেয়া ফারসিম মান্নান মোহাম্মদী এবং ফিরোজ আহমদদের সাথে এবং নিজের এই মতের স্বপক্ষে উনি ভালো কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। লেখকের মতে, যে শব্দগুলো প্রচলিত সেটাই ব্যবহার করা উচিত। একটা যুক্তি উল্লেখ করি-
ক্রিকেটে "দুসরা" কোন ধরনের বোলিং এটা কোনো ক্রিকেট প্রেমিককে বুঝিয়ে বলতে হয় না, তা তিনি যে-ভাষারই হোন না কেন। তা বোলিংটা "other one" না হয়ে "দুসরা" হলো কেন? কেননা এটা আবিষ্কার করেছেন সাকলায়েন মুশতাক এবং তিনি যেহেতু উর্দুতে দুসরা বলেছেন- সেহেতু আস্ট্রেলিয়ানরাও এই বোলিংকে দুসরাই বলে, অন্য কোনো শব্দ দিয়ে নির্দিষ্ট করার কসরত করে না
বাংলা ভাষায় যে সংখ্যাপদ্ধতি ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়, তা কি নিছক মুখস্থ করানো হয়, নাকি অন্য ভাষার মতো (ইংরেজি, চায়নিজ) তেমন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন না থাকায় ব্যাপারটা আমাদের কোনোভাবে প্রভাবিত করে?...বইয়ের সবচেয়ে সৃজনশীল লিখা সম্ভবত পঞ্চম লিখাটি- 'বাংলা নিউমেরাল প্রসঙ্গে' যেখানে লেখক এই ব্যাপারটি দেখিয়েছেন। বাঙালীর গনিত-ভীতির মূলেও যে এই ভাষার সংখ্যাপদ্ধতি বেশ প্রভাব রাখে তা লেখকের এই লিখাটা পড়লে সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। লিখার শেষদিকে এসে ইন্দো-ইয়োরোপিয়ান মূল অনুসরনে লেখক নিজেই একটি সংখ্যা-পদ্ধতির প্রস্তাব করেছেন- আমার ধারনা, পুরো বইয়ের সবচেয়ে চমকপ্রদ অংশ এটিই।
এই প্রসঙ্গগুলো ছাড়াও শাহবাগ আন্দোলন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আস্তিক-নাস্তিক প্রসঙ্গ, দেশের উচ্চবিত্তদের দেশ নিয়ে মানসিকতা, দেশে ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যৎ, প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালির চুলকানী ইত্যাদি চমৎকার বিষয়বস্তু অল্প কথায় সহজভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
বইয়ের সর্বশেষ লিখাটি লেখক তাঁর মেয়েকে উদ্দেশ করে লিখেছেন। 'পিতা কন্যাকে' নামক এই লিখায় তিনি মেয়েকে বলতে চেয়েছেন সামনে কি আসছে, সম্ভাব্য কি তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছে, কি করতে হবে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, একজন মানুষ শুধু লেখক হিসেবেই তাঁর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে লিখে যাবেন তা নয়, বরং এই কাজটা সব বাবাদের জন্যেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত...।
কেন উচিত? লিখালিখিতে self reflection টা বেশ ভালোভাবে বোঝা যায়। আর যে নিজেকে বুঝতে পারে, নিজের পরিপার্শ্বকে ভালোভাবে বুঝতে পারে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে সে-ই অর্থবহ কিছু রেখে যেতে যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, লেখক এই ক্ষেত্রে সফল একজন মানুষ।
বই সম্পর্কিত তথ্য
বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে
ফাহাম আব্দুস সালাম
প্রকাশনীঃ একাদেমিয়া
প্রকাশকালঃ ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০